পড়ন্ত বিকেল। দুই দফা দাবদাহের পর তাপমাত্রাটা সহনীয় হয়েছিল তখন। খানিকটা স্বস্তির আশায় হাঁটতে বের হলাম। রাজধানীর আফতাবনগরের খোলা প্রান্তর। ছুটির দিন হওয়ায় অনেকেই বের হয়েছে। দেখলাম, জামতলায় ছোট একটা জটলা। একটা অনলাইন পত্রিকার রিপোর্টার ও ক্যামেরাপারসন সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন। সাক্ষাৎকারদাতা দু-জন রিকশাওয়ালা। আগ্রহ জাগল। জটলার পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম।
‘‘বাজেট দিয়া আমাগো কী হইবো? বাজেট তো অইলো ধনীগো লেইগা। আমাগো কথা কে ভাবে? সরকার তো শুধু ত্যালা মাথায় ত্যাল দেয়।’’ বলল প্রথম রিকশাওয়ালা। বুঝলাম, সাধারণ মানুষের বাজেট ভাবনা কী? তাই জানতে চাওয়া হয়েছে। ‘‘ত্রিশ বছর রিকশা চালাইতাছি, নিজে একটা রিকশা কিনবার পারলাম না। যতই কামাই, থাহে না কিছুই। সব যায় ধনীগো পকেটে।’’
দেশে ধনী-গরিবের ব্যবধান যে ক্রমাগত বাড়ছে, এ নিয়ে রিকশাচালকদের মতো আক্ষেপ জানালেন সাধারণ মানুষও। অস্বীকার করার উপায় নেই যে, দেশে উন্নয়নের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে আয় বৈষম্য। বাড়ছে ধনী-গরিবের ব্যবধান। উন্নয়ন হচ্ছে। দারিদ্র্য কমছে। মাথাপিছু আয় বাড়ছে। জিডিপির প্রবৃদ্ধি বাড়ছে। বাড়ছে জীবনযাত্রার মানও। কিন্তু আয় যেমন বাড়ছে, তেমনি বাড়ছে আয়ের বৈষম্য।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো বিবিএস-এর ২০২২ সালের জরিপ বলছে, ধনী ৫ ভাগ পরিবারের কাছে আছে মোট দেশজ আয়ের ৩০ শতাংশের বেশি। ২০১৬ সালেও যা ছিল ২৭ দশমিক ৮২ শতাংশ। আর দেশজ আয়ে দরিদ্রতম পাঁচ ভাগ জনগোষ্ঠীর মালিকানা মাত্র দশমিক ৩৭ শতাংশ। আয় বৈষম্য পরিমাপকারী গিনি সহগ ২০২২ সালে বেড়ে ০.৪৯৯ শতাংশ পৌঁছায়। যা ২০১৬ সালে ছিল ০.৪৮২ এবং ২০১০ সালে ছিল ০.৪৫৮। অর্থাৎ দেশে আয়ের ক্ষেত্রে বৈষম্য বেড়েছে। এ অবস্থা দেশের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের পথে অদৃশ্য হুমকি।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, যে হারে সম্পদ বাড়ছে ওই তুলনায় কর্মসংস্থান বাড়ছে না। ঋণখেলাপির কাছ থেকে অর্থ আদায় না করে তাদের আরও বেশি সুবিধা দেয়া হচ্ছে। কৃষকরা বিদ্যুৎ না পেলেও নানা সুবিধা দেয়া হচ্ছে ধনীদের। এ কারণে সুবিধাভোগীদের হাতে অবৈধ পুঁজি পুঞ্জীভূত হচ্ছে। আইএমএফ-এর ২০২২ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত আড়াই দশকে দক্ষিণ এশিয়ার যে তিনটি দেশে আয় বৈষম্য ব্যাপক হারে বেড়েছে। দেশ তিনটি হলো বাংলাদেশ, ভারত ও শ্রীলঙ্কা।
আয়-বৈষম্য মূলত বাজার অর্থনীতিরই একটি স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য, যার মূলে রয়েছে সম্পদ ও মানব পুঁজির অসম বন্টন। ব্যাংক ঋণের কথা ধরা যাক, ধনীরা বিশাল অঙ্কের ঋণ নিতে পারেন। অথচ ঋণ পরিশোধের হার তাদের মধ্যেই কম। ব্যাংকগুলো তাদের ওপর বেশি চাপ দিতে পারে না। বরং এক ঋণ পরিশোধের আগেই তাদের আরও বড় ঋণ দেয়া হয়। অথচ ছোট ব্যবসায়ী বা উদ্যোক্তাদের ঋণ পেতে অনেক ধরনা দিতে হয়।
অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, অসঙ্গতি রয়েছে দেশের কর ব্যবস্থায়ও। যাদের বেশি করে ট্যাক্স দেয়ার কথা তারা কম ট্যাক্স দেয়। আর যারা কম ট্যাক্স দেয়ার কথা তারাই দেয় বেশি ট্যাক্স। বাংলাদেশে অর্থনীতি সমিতির গবেষণা বলছে, ধনী ও উচ্চমধ্যবিত্তদের ৮৭ শতাংশই কোনো ধরনের আয়কর দেন না। এই কারণে এনবিআর কর আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারে না৷
এই যদি হয় অবস্থা তাহলে তো ধনীরা আরও ধনী হবেই। এ সমস্যার সমাধান কোথা্য়? অর্থনীতিবিদরা বলছেন, আয় বৈষম্য কমাতে সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো প্রগতিশীল করব্যবস্থা। এক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ কর, অর্থাৎ আয়করের আওতায় করযোগ্য সবাইকে আনতে হবে। কর খাত সম্প্রসারণ করে রাজস্ব বাড়ানো গেলে সেটাই হবে আয় বৈষম্য কমানোর প্রধান হাতিয়ার।
পরিশেষে এটা মনে রাখা খুবই জরুরি যে, শুধু কর ব্যবস্থার সংস্কারই আয় বৈষম্য কমানোর জন্য যথেষ্ট নয়। পাশাপাশি প্রয়োজন সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষের অবস্থার উন্নয়নে বহুমুখী উদ্যোগ। সর্বস্তরের মানুষের কাছে উন্নয়নের সুফল পৌঁছে দিতে হলে নতুন কর্মসংস্থান তৈরি কতে হবে। প্রতিটি স্তরে দক্ষতা বৃদ্ধি এবং দক্ষতা অনুযায়ী কাজের ব্যবস্থা করতে হবে। যার জন্য প্রয়োজন উপযুক্ত বরাদ্দ এবং সেই বরাদ্দের উপযুক্ত প্রয়োগ। অর্থাৎ প্রয়োজন আয় বৈষম্য কমানোর বাজেট।
আশার কথা হলো, ধনী-গরিবের ব্যবধান কমিয়ে আনতে সরকার মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদী বহুমাত্রিক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে। আগামী বাজেটে সরকারের সেই পরিকল্পনা ও উন্নয়ন কৌশলের সফল প্রয়োগ ঘটবে সেটাই সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা।
লেখক: অ্যাসোসিয়েট নিউজ এডিটর, একাত্তর টিভি